আগামীকাল চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ এর একটি টিউবের উদ্বোধন করা হবে । সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে টানেলের দুটি টিউবের মধ্যে প্রথম টিউবটি উদ্বোধন করবেন।
নদীর তলদেশে টানেল এবং এটি এক সময় ছিলো স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন এখন বাস্তবে রূপ নিয়েছে। সব ঠিক থাকলে আগামীকাল টানেল যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশীদ বলেন, ‘সফলভাবে স্থাপন শেষে টানেলের দুটি টিউবের মধ্যে শনিবার প্রথম টিউবটি উদ্বোধন করা হবে। ইতিমধ্যে সব প্রস্তুতি শেষ করা হয়েছে।তিনি আরো বলেন, ‘আগামী মাসেই প্রথম টানেলটি যান চলাচলের উন্মুক্ত করে দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।’
হারুনুর রশীদ বলেন, ‘প্রথম টিউবের কাজ পুরোপুরি শেষ হওয়ার পাশাপাশি পুরো প্রকল্পের কাজ ৯৮ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। দুই টিউবের অভ্যন্তরে সড়ক এবং টানেলের দুই প্রান্তে সংযোগ সড়ক ও গোলচত্বরের নির্মাণ কাজও প্রায় শেষের দিকে। টানেলের ভেতরে বৈদ্যুতিক লাইট স্থাপন, অগ্নিপ্রতিরোধক বোর্ড স্থাপন, বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা, পাম্প স্থাপন, টানেলের ভেতরে সাজসজ্জা ও বাতাস চলাচলের জন্য ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা চালুর কাজ চলছে। নদীর তলদেশে হওয়ায় যেকোনও সময় পানি জমতে পারে আশঙ্কায় টানেলের মধ্যে বসানো হচ্ছে ৫২টি সেচ পাম্প। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
টানেলে নদীর তলদেশে স্থাপন করা হয়েছে দুটি টিউব। একটি টিউবে কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে যাতে বিকল্প পথে গাড়ি চালানো যায়, সেটিরও কাজ চলছে। বাতি ও পাম্প স্থাপন, ড্রেনেজ ব্যবস্থা তৈরির কাজও সমানতালে চলছে। নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ সড়ক, ৭৭২ মিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভার। এখন চলছে কর্ণফুলীর দক্ষিণ প্রান্তে আনোয়ারা অংশে টোল প্লাজা নির্মাণের কাজ।
কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে ১৮ থেকে ৩৬ মিটার গভীরতায় সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছে। নদীর মাঝ পয়েন্টে এই গভীরতা প্রায় ১৫০ ফুট। প্রতিটি ৩৫ ফুট প্রশস্ত ও ১৬ ফুট উচ্চতার। চট্টগ্রামে পতেঙ্গার নেভাল একাডেমি প্রান্থ থেকে শুরু হয়ে টানেলটি নদীর তলদেশ হয়ে চলে গেছে আনোয়ারার চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড এবং কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার লিমিটেড কারখানার মাঝামাঝি স্থানে।
চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় নদীর তলদেশে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে এই টানেল নির্মিত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে নদীর তলদেশে নির্মিত এটিই প্রথম টানেল। পতেঙ্গা থেকে কর্ণফুলীর অপর প্রান্তে আনোয়ারা পর্যন্ত দুই টিউব সংবলিত মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। টানেল টিউবের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার এবং ভেতরের ব্যাস ১০ দশমিক ৮০ মিটার। টানেলের ভেতর দিয়ে নদীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে পৌঁছাতে সর্বোচ্চ ৬ মিনিট সময় লাগতে পারে বলে প্রকল্প কর্মকর্তারা ।
টানেল নির্মাণের আগে ২০১৩ সালে করা সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, টানেল চালুর পর এর ভেতর দিয়ে বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারবে। সেই হিসাবে দিনে চলতে পারবে ১৭ হাজার ২৬০টি গাড়ি। ২০২৫ সাল নাগাদ টানেল দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে, যার মধ্যে অর্ধেক থাকবে পণ্যবাহী যানবাহন। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন গড়ে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি এবং ২০৬৭ সাল নাগাদ ১ লাখ ৬২ হাজার যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে।
টানেল নির্মাণে মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে ৪ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। বাকি ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা দিচ্ছে চীন সরকার। চীনের এক্সিম ব্যাংক ২ শতাংশ হারে ২০ বছর মেয়াদি এ ঋণ দিয়েছে। চীনের কমিউনিকেশন ও কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি) টানেল নির্মাণের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। তবে ডলারের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে প্রকল্পের ব্যয় আরও বাড়বে বলে প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে।
২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেন। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম টানেল টিউবের বোরিং কাজ উদ্বোধন করেন।
শনিবার টানেলের প্রথম টিউব উদ্বোধন উপলক্ষ্যে সার্বিক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। এই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা র্ভাচুয়ালি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। এছাড়া চট্টগ্রাম প্রান্তে টানেলের প্রবেশ মুখের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে একাধিক মন্ত্রী, সাংসদ সদস্য, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।
মাহফুজা ২৫-১১